সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও ফজিলত জানুন
ইসলামের ইবাদতগুলোর মধ্যে নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মুমিনের আত্মশুদ্ধির জন্য এক অনন্য মাধ্যম। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ ছাড়াও ইসলাম ধর্মে কিছু নফল নামাজ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। তেমনই একটি বিশেষ নফল নামাজ হচ্ছে সালাতুল তাসবিহ। এই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এবং তাঁর প্রশংসা ও তাসবিহ পাঠ করা হয়।
আজকের এই আলোচনায় আমরা সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম, ফজিলত, এবং কেন এটি আদায় করা উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলব।আপনারা লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে সালাতুল তাসবিহ নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং উপকৃত হতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
সালাতুল তাসবিহ নামাজ কী?
সালাতুল তাসবিহ নামাজ মূলত একটি নফল নামাজ যা আল্লাহর প্রশংসা, মহানতা এবং ক্ষমার আবেদন হিসেবে পড়া হয়। এই নামাজের বিশেষত্ব হলো, এতে মোট ৩০০ বার "তাসবিহ" পাঠ করতে হয়। তাসবিহ বলতে সাধারণত "সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার" এই চারটি বাক্য একত্রে পড়া হয়, যা আল্লাহর প্রশংসা ও মহানতা ঘোষণা করে।
এই নামাজটি মূলত ৪ রাকাতের একটি নফল নামাজ, এবং এটি একবারে একটানা আদায় করতে হয়। এটি যে কোনো সময় আদায় করা যেতে পারে, তবে কিছু বিশেষ সময় আছে, যেগুলোতে এই নামাজ পড়া উত্তম বলে উল্লেখ রয়েছে।
সালাতুল তাসবিহ নামাজের ফজিলত
সালাতুল তাসবিহ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিসে উল্লেখ আছে। এই নামাজ পড়ার মাধ্যমে বান্দার সকল গুনাহ ক্ষমা করা হয় এবং আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়।
হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার চাচা হযরত আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কে বলেছিলেন:
“হে আব্বাস! তোমাকে কি আমি একটি দান করব, তোমাকে কি আমি একটি উপহার দিব? আমি কি তোমার জন্য একটি ভালো কাজের পরামর্শ দিব? আমি বলি যে, তুমি সালাতুল তাসবিহ পড়। এই নামাজ পড়লে তোমার সকল গুনাহ—পুরাতন, নতুন, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, ছোট-বড়, প্রকাশ্য বা গোপন—সব আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।” (আবু দাউদ, তিরমিজি)
এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি, সালাতুল তাসবিহ নামাজের ফজিলত অনেক বেশি। এটি পড়ার মাধ্যমে শুধু গুনাহ ক্ষমাই হয় না, বরং আমাদের জীবনেও বরকত আসে এবং আখিরাতে বিশাল পুরস্কার লাভ করা যায়।হাদিসে আরও এসেছে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এই নামাজ সম্পর্কে বলেছেন
“যদি আপনি প্রতিদিন আমল করতে পারেন, তবে তা করুন। আর যদি না পারেন, তবে প্রতি জুমাবারে একবার। যদি প্রতি জুমাবারে না করেন, তবে প্রতি মাসে একবার। আর যদি তা-ও না পারেন, তবে সারাজীবনে একবার।”
অতএব, প্রিয় পাঠ্ক, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সালাতুল তাসবিহ নামাজের গুরুত্ব ও মানুষের জীবনে এটি আদায় করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। তাই আমাদের সকলের উচিত জীবনে একবার হলেও এই নামাজটি সঠিকভাবে আদায় করা।
সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম
সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম কিছুটা ভিন্ন এবং এতে তাসবিহ পড়ার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। নিচে ধাপে ধাপে সালাতুল তাসবিহ নামাজের আদায়ের পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
১. নিয়ত করা
প্রথমেই নিয়ত করতে হবে। মনে মনে বা উচ্চারণ করে বলতে পারেন, “আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সালাতুল তাসবিহের ৪ রাকাত নফল নামাজ আদায় করছি।”
২. প্রথম রাকাত আদায়
তাকবির দিয়ে নামাজ শুরু করুন: "আল্লাহু আকবার" বলে নামাজ শুরু করুন।
সানা পড়ুন: "সুবহানাকাল্লাহুম্মা" পড়ার পর ১৫ বার "সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার" তাসবিহ পড়ুন।
সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরা পড়ুন: এরপর সুরা ফাতিহা এবং অন্য কোনো ছোট সুরা পড়ুন। সুরা পড়ার পর আবার ১০ বার একই তাসবিহ পড়ুন।
রুকুতে গিয়ে তাসবিহ পড়ুন: রুকুতে যান এবং রুকুর তাসবিহ "সুবহানা রাব্বিয়াল আজীম" তিনবার পড়ার পর ১০ বার "সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার" তাসবিহ পড়ুন।
রুকু থেকে উঠে তাসবিহ পড়ুন: রুকু থেকে উঠার পর "সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ, রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ" বলার পর আবার ১০ বার তাসবিহ পড়ুন।
সিজদায় তাসবিহ পড়ুন: প্রথম সিজদায় যান এবং তিনবার "সুবহানা রাব্বিয়াল আ'লা" বলার পর ১০ বার তাসবিহ পড়ুন।
সিজদা থেকে উঠার পর: দুই সিজদার মাঝে বসে আবার ১০ বার তাসবিহ পড়ুন।
দ্বিতীয় সিজদায় তাসবিহ পড়ুন: দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে তিনবার "সুবহানা রাব্বিয়াল আ'লা" বলার পর ১০ বার তাসবিহ পড়ুন।
এইভাবে এক রাকাত নামাজ শেষ করুন। প্রথম রাকাতেই ৭৫ বার তাসবিহ পড়া হয়।
৩. দ্বিতীয় রাকাত আদায়
দ্বিতীয় রাকাতের নিয়ম প্রথম রাকাতের মতোই। তবে এবার সানা পড়তে হবে না। সুরা ফাতিহা পড়ার পর থেকে একইভাবে ৭৫ বার তাসবিহ পড়ুন।
৪. তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত
তৃতীয় এবং চতুর্থ রাকাতও একই নিয়মে আদায় করতে হবে। প্রতি রাকাতে ৭৫ বার তাসবিহ পড়বেন। চার রাকাত মিলিয়ে মোট ৩০০ বার তাসবিহ পড়তে হবে।
৫. শেষ সালাম ফেরানো
চতুর্থ রাকাতের শেষে তাশাহুদ, দুরুদ এবং অন্যান্য দোয়া পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করুন।
মহিলাদের সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম
সালাতুল তাসবিহ নামাজ মহিলারা খুব সহজেই তাদের ঘরে আদায় করতে পারেন। এটি চার রাকাত নফল নামাজ এবং এ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ রহমত এবং গুনাহ মাফের প্রার্থনা করা হয়। মহিলাদের জন্য সালাতুল তাসবিহ পড়ার নিয়ম পুরুষদের মতোই, তবে কিছু ক্ষেত্রে নামাজের বিশেষ আদব ও শালীনতা মেনে চলতে হয়।
সালাতুল তাসবিহ নামাজের মাধ্যমে সকল গুনাহ ক্ষমা করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয় এবং এই নামাজ পড়ার জন্য রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন। তাই মহিলাদেরও উচিত এই নামাজ মাঝে মাঝে আদায় করা, যাতে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর রহমত লাভ হয়।
সালাতুল তাসবিহের উপযুক্ত সময়
সালাতুল তাসবিহ যে কোনো সময় পড়া যেতে পারে, তবে কিছু বিশেষ সময় আছে, যখন এই নামাজ পড়া উত্তম। সাধারণত যোহরের নামাজের পরে, রাতে তাহাজ্জুদের সময় বা দিনে চাশতের নামাজের সময় এটি পড়া হয়। তবে এই নামাজ জুমার দিনে আদায় করাও বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
সালাতুল তাসবিহের বিশেষ ফজিলত
সালাতুল তাসবিহ নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চাওয়া হয় এবং বিশেষ পুরস্কার লাভ করা যায়। হাদিসে এসেছে যে, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতুল তাসবিহ নামাজের মাধ্যমে মানুষের গুনাহ ক্ষমা করার কথা উল্লেখ করেছেন।
১. গুনাহ মাফ: এই নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহ সকল ধরনের গুনাহ মাফ করে দেন। এটি ছোট বা বড়, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সকল গুনাহের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভের একটি বিশেষ সুযোগ।
২. আল্লাহর নৈকট্য অর্জন: সালাতুল তাসবিহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায় এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হয়। যারা নিয়মিত এই নামাজ পড়েন, তাদের জীবনে আল্লাহর বিশেষ রহমত আসে।
৩. আখিরাতের পুরস্কার: এই নামাজের মাধ্যমে আখিরাতে অসীম পুরস্কার লাভ করা যাবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য জন্নাতে বিশেষ মর্যাদা দান করবেন।
কেন সালাতুল তাসবিহ পড়া উচিত?
আমাদের জীবনে যতই পাপ হয়ে থাকুক না কেন, আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের গুনাহ মাফের জন্য সর্বদা অপেক্ষা করেন। সালাতুল তাসবিহ এমন একটি নামাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চায় এবং তাঁর অনুগ্রহ কামনা করে। এই নামাজের ফজিলত এবং পুরস্কার এত বেশি যে, এটি জীবনে অন্তত একবার আদায় করা উচিত। এটি আমাদের অন্তরের পবিত্রতা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের একটি বিশেষ উপায়।
প্রশ্নোত্তর পর্ব
১. নামাজের তাসবিহ কখন পড়তে হয়?
নামাজের তাসবিহ সাধারণত সালাতুল তাসবিহ নামাজে পড়া হয়, যা একটি বিশেষ নফল নামাজ। এই নামাজে নির্দিষ্ট সংখ্যক তাসবিহ পাঠ করার নিয়ম রয়েছে। সালাতুল তাসবিহ মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গুনাহ মাফের উদ্দেশ্যে আদায় করা হয় এবং সাধারণত দিনে বা রাতে একবারই এই নামাজ পড়া হয়।
তবে দিনে যেকোনো সময়েই এটি আদায় করা যেতে পারে, বিশেষত যোহরের পরে, রাতে তাহাজ্জুদের সময় বা দিনে চাশতের সময়। জুমার দিনের গুরুত্বও এখানে বেশি বলে মনে করা হয়, কারণ জুমার দিন ইবাদত-বন্দেগির জন্য অতিরিক্ত ফজিলতপূর্ণ।
২. তাসবিহ কিভাবে করতে হয়?
সালাতুল তাসবিহ নামাজের জন্য নির্দিষ্টভাবে এই তাসবিহটি পড়তে হয়: “সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার”। সালাতুল তাসবিহ নামাজে ৪ রাকাতে মোট ৩০০ বার তাসবিহ পড়তে হয়।
প্রতিটি রাকাতে নিম্নলিখিতভাবে তাসবিহ পড়তে হয়:
সানা পড়ার পর ১৫ বার
সুরা ফাতিহা এবং অন্য সুরা পড়ার পর ১০ বার
রুকুতে গিয়ে ১০ বার
রুকু থেকে উঠে সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ বলার পর ১০ বার
প্রথম সিজদায় ১০ বার
দুই সিজদার মাঝে বসে ১০ বার
দ্বিতীয় সিজদায় ১০ বার
এইভাবে প্রতিটি রাকাতে ৭৫ বার তাসবিহ পড়া হয় এবং ৪ রাকাত মিলিয়ে মোট ৩০০ বার তাসবিহ সম্পন্ন হয়।
৩. সালাতুত তাসবিহ কত রাকাত?
সালাতুল তাসবিহ একটি ৪ রাকাত নফল নামাজ। এটি একবারে একটানা পড়তে হয়। তবে কেউ চাইলে এই ৪ রাকাত দুই রাকাত করে সালাম ফিরিয়ে পৃথকভাবে আদায় করতে পারে, যদিও একসঙ্গে ৪ রাকাত পড়ার ফজিলত অধিক বলে উল্লেখ রয়েছে।
৪. সালাতুল তাসবিহ নামাজ জামাতে পড়া যাবে কি?
সাধারণত সালাতুল তাসবিহ নামাজ একাকী আদায় করা উত্তম, কারণ এটি মূলত ব্যক্তিগত ইবাদত এবং নফল নামাজ। এই নামাজের বিশেষ ফজিলত এবং তাসবিহের নির্দিষ্ট নিয়ম থাকার কারণে এটি একা পড়াই উত্তম। তবে কেউ চাইলে জামাতে পড়তে পারে, তবে ইসলামিক স্কলারদের মতে এটি একাকী পড়াই সুন্নাহসম্মত।
উপসংহার
সালাতুল তাসবিহ একটি বিশেষ নফল নামাজ, যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে পাপের ক্ষমা চাওয়া এবং তাঁর প্রশংসা করা হয়। নিয়মিত এই নামাজ পড়া আমাদের গুনাহ মাফের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শান্তি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সাহায্য করে। ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের মধ্যেই আল্লাহর রহমত এবং কল্যাণ রয়েছে। সালাতুল তাসবিহও তেমনই একটি ইবাদত, যা আমাদের জীবনে বরকত নিয়ে আসতে পারে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে এই নামাজ আদায়ের তৌফিক দান করুন এবং তাঁর রহমত ও মাগফিরাত লাভের সুযোগ দান করুন। আমিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url